শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি: এসআই মোঃ সোহেল রানা।

শবে বরাত (লাইলাতুল বরাত) ইসলামী ক্যালেন্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা শাবান মাসের ১৪ তারিখের রাতে পালিত হয়। এটি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। তবে শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী মনীষীদের ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করা জরুরি।

শবে বরাতের গুরুত্ব

শবে বরাতকে সাধারণত ক্ষমা ও রহমতের রাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক মুসলিম বিশ্বাস করেন যে এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন এবং পরবর্তী বছরের তাকদির নির্ধারণ করেন। যদিও এই বিশ্বাসের পক্ষে কিছু দুর্বল হাদিস পাওয়া যায়, তবে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না যা নিশ্চিতভাবে এই দাবিকে সমর্থন করে।

কুরআনের দৃষ্টিতে শবে বরাত

কুরআনে স্পষ্টভাবে শবে বরাতের নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিছু ব্যাখ্যাকারী সূরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪) এর “লাইলাতুম মুবারাকা” (বরকতময় রাত্রি) শব্দগুচ্ছকে শবে বরাতের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, এটি মূলত শবে কদরের রাতকে নির্দেশ করে, কারণ কুরআন সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে কুরআন লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয়েছে (সূরা আল-কদর ৯৭:১-৩)।

হাদিসের আলোকে শবে বরাত

শবে বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস পাওয়া যায়, তবে অধিকাংশ হাদিস দুর্বল (দাঈফ) বা জাল (মিথ্যা) হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের প্রতি দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টি দেন। তবে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা একথা সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। হাদিস বিশারদগণ যেমন ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলোকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। ইবনে তাইমিয়াহ এবং শাইখ আলবানির মতো প্রখ্যাত ইসলামি স্কলারগণও শবে বরাতের নির্দিষ্ট আমল সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ খুঁজে পাননি।

শবে বরাত পালনের প্রচলিত রীতি

বিভিন্ন দেশে শবে বরাত উপলক্ষে নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও ইস্তেগফার পড়া হয়। কেউ কেউ মনে করেন, এই রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। আবার, কিছু দেশে মিষ্টান্ন বিতরণ, আতশবাজি এবং আলোকসজ্জার মতো কাজও করা হয়, যা ইসলামী রীতির সাথে সম্পর্কিত নয়।

প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

শবে বরাতের বিশেষ কোনো আমল বা ইবাদত করার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল পাওয়া যায় না। ইসলামে ইবাদত ও উৎসব পালনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকতে হয়। প্রামাণ্য দলিল ছাড়া বিশেষ কোনো রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদত করা বিদআত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

তবে, যেহেতু শাবান মাসে রোজা রাখা ও ইবাদতের প্রতি রাসুল (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, তাই সাধারণ নফল ইবাদত করা নিষিদ্ধ নয়। বরং এই রাতে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত করতে চান, তাহলে তা করা যেতে পারে, তবে এটাকে বাধ্যতামূলক মনে করা যাবে না।

শেষকথা

শবে বরাত সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিশুদ্ধ দলিলের আলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এটি পালন করা ফরজ বা সুন্নাহ নয়। ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুসারে শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। তবে যদি কেউ এই রাতে ইবাদত করতে চান, তাহলে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে করা যেতে পারে, কিন্তু সমাজের উপর বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়। আমাদের উচিত কুরআন ও সহিহ হাদিসের উপর ভিত্তি করে আমল করা এবং বিদআত ও কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকা।

Scroll to Top