♦বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণা এবং এসব থেকে নিরাপদে থাকার জন্য করণীয় ও বর্জনীয়♦
ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা অনেক সহজ এবং দ্রুততর হয়েছে। তবে এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রচুর, এবং অপরাধীরা তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে মানুষকে নানা ধরনের প্রতারণার শিকার করছে। তাই, আমাদের এই অনলাইন পরিবেশে নিরাপদ থাকার জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।
বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা:-
ফিশিং (Phishing):-
ফিশিং একটি জনপ্রিয় অনলাইন প্রতারণা কৌশল, যেখানে প্রতারকরা মিথ্যা ইমেইল, মেসেজ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার চেষ্টা করে। এটি সাধারণত ইমেইলে নিরাপত্তা বা অ্যাকাউন্ট আপডেট সম্পর্কিত মিথ্যা বার্তা পাঠিয়ে ব্যবহারকারীদের পাসওয়ার্ড বা ব্যাংক তথ্য চুরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।
অনলাইন শপিং স্ক্যাম:-
অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের সময়, অনেক সময় অপরাধীরা সস্তা বা ‘অবিশ্বাস্য’ অফারের মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করে তাদের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এর মধ্যে পণ্য পৌঁছানোর বদলে ভুয়া পণ্য বা কিছুই প্রেরণ করা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যাম:-
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে অনেক সময় মিথ্যা প্রোফাইল তৈরি করা হয়। অপরাধীরা প্রোফাইল হ্যাক করে বন্ধুদের থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় বা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। এছাড়াও, বিভিন্ন “ফ্রি গিফট” বা “লাকি ড্র” এর মাধ্যমে ব্যবহাকারীকে ধোঁকা দেয়া হয়।
কর্মসংস্থান স্ক্যাম:-
অনেক অনলাইন সাইট চাকরির সুযোগের নাম দিয়ে টাকা নেয়, আবার কখনো চাকরি পাওয়া যায় না। এই ধরনের স্ক্যামগুলো সাধারণত “অ্যাডভারটাইজিং ফি” বা “রেজিস্ট্রেশন ফি” নাম দিয়ে টাকা দাবি করে থাকে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি স্ক্যাম:-
ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে বিভিন্ন স্ক্যাম চলছে, যেখানে অপরাধীরা “বড় লাভের সুযোগ” বা “ফ্রি ক্রিপ্টো” এর নাম দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে। একে “পিরামিড স্কিম” বা “হাই রিটার্ন স্ক্যাম” বলা হয়, যা গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
অনলাইন ডেটিং স্ক্যাম:-
অনলাইন ডেটিং সাইট বা অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে নানা ধরনের প্রতারণা সংঘটিত হচ্ছে। অনেক সময় অপরাধীরা ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করে। একসময়, তারা তাদের কষ্ট বা সমস্যার কথা বলে, অজুহাত তৈরি করে টাকা বা উপহার পাঠানোর জন্য প্ররোচিত করে। এই ধরনের প্রতারণা একাধিক লোকের মধ্যে সম্পর্কের আস্থা নষ্ট করতে পারে এবং মানুষের মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি করতে পারে।
টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্ক্যাম:-
অনেক সময়, প্রতারকরা মিথ্যা টেকনিক্যাল সাপোর্ট দাবি করে ইউজারের কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে প্রবেশ করে তথ্য চুরি করে। এক্ষেত্রে, অপরাধীরা একটি মিথ্যা ফোন নম্বর বা ইমেইল আইডি থেকে যোগাযোগ করে এবং বলে যে, “আপনার ডিভাইসের সমস্যা রয়েছে”, তারপর ইউজারের অনুমতি নিয়ে তাদের ডিভাইসে প্রবেশ করে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত ডেটা, পাসওয়ার্ড বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়।
বিলিং স্ক্যাম:-
বিলিং স্ক্যাম খুবই প্রচলিত একটি অনলাইন প্রতারণা, যেখানে সেবা বা পণ্য কিনে নেওয়ার পর, ব্যবহারকারীর অজান্তে তাদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে অতিরিক্ত অর্থ কেটে নেওয়া হয়। যেমন, কিছু ওয়েবসাইটের সাবস্ক্রিপশন ফি প্রদান করে, কিন্তু পরবর্তীতে গ্রাহকের অজ্ঞাতে সেই সাবস্ক্রিপশন নিয়মিত নবীকরণ হয়ে চলে, যার ফলে ব্যবহারকারী জানতেও পারে না যে তার টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে।
ভূয়া দাতব্য সংস্থা:-
অনলাইন দাতব্য সংগঠন বা ত্রাণ প্রচারণা চালানো প্রতারণার একটি গুরুতর ধরন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কিছু অপরাধী দল বা ব্যক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভুয়া দাতব্য সংস্থা চালিয়ে দান সংগ্রহ করে। তারা সাধারণত এমন সময় এই প্রতারণা চালায় যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্যোগ ঘটে এবং মানুষের সহানুভূতির সুযোগ নেয়।
ব্যক্তিগত তথ্য চুরি:-
অনেক সময়, অনলাইনে একাধিক সাইট ও অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। যদিও এগুলো সচরাচর সেবা প্রদানের অংশ হিসেবে করা হয়, তবে কিছু সাইট বা অ্যাপ্লিকেশন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এবং এই তথ্য পরে হ্যাকারদের হাতে চলে যেতে পারে।
অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণা থেকে নিরাপদ থাকার করণীয়:-
ফিশিং ইমেইল ও মেসেজ থেকে সতর্কতা:-
কখনোই সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করবেন না: ইমেইলে বা মেসেজে যদি কোনো লিঙ্ক থাকে এবং আপনি সন্দেহ করেন, তবে সেটিতে ক্লিক না করে সরাসরি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে তথ্য চেক করুন।
ইমেইল অ্যাড্রেস যাচাই করুন:-
যেকোনো ইমেইল পাঠানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য সঠিক প্রেরক বা ডোমেইন যাচাই করুন। খেয়াল রাখুন, অনেক সময় অপরাধীরা অফিসিয়াল ইমেইল ঠিকানার সাথে সামান্য পরিবর্তন করে মিথ্যা বার্তা পাঠায়।
আবশ্যকীয় সফটওয়্যার আপডেট রাখুন:-
আপনার ডিভাইসের সিস্টেম এবং অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার সর্বদা আপডেট রাখুন। নতুন আপডেটগুলি সাধারণত নিরাপত্তা প্যাচ অন্তর্ভুক্ত থাকে যা হ্যাকারদের থেকে সুরক্ষা দেয়।
জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন:-
সহজ বা অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ডের বদলে দীর্ঘ এবং শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। আপনার পাসওয়ার্ডে বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ চিহ্ন অন্তর্ভুক্ত করুন।
সম্ভব হলে ২FA (Two-Factor Authentication) চালু রাখুন, যা একাধিক স্তরের সুরক্ষা প্রদান করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সতর্কতা:-
সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কম শেয়ার করুন। বিশেষ করে আপনার ফিনান্সিয়াল ডেটা, ঠিকানা বা জন্ম তারিখ শেয়ার না করাই ভালো। অপরিচিত প্রোফাইল বা আউট অফ ফ্রেন্ডলিস্ট কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার আগে যাচাই করে নিন।
বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা:-
অনলাইনে কেনাকাটা করার সময় শুধুমাত্র পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন। “https” এর মাধ্যমে সুরক্ষিত লিঙ্ক চেক করুন, যা নিরাপদ কেনাকাটার নিশ্চয়তা দেয়। রিভিউ ও রেটিং দেখে পণ্য বা সাইট সম্পর্কে পূর্ববর্তী গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা জানুন।
ওয়াই-ফাই নিরাপত্তা বজায় রাখুন:-
পাবলিক বা উন্মুক্ত ওয়াই-ফাই ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকুন। হ্যাকাররা সহজেই এই ওয়াই-ফাই মাধ্যমে আপনার ডেটা চুরি করতে পারে।
এমন ক্ষেত্রে VPN (Virtual Private Network) ব্যবহার করা উত্তম, যা আপনার ইন্টারনেট কানেকশনকে এনক্রিপ্ট করে।
অতিরিক্ত পেমেন্ট বা রেজিস্ট্রেশন ফি থেকে সতর্কতা:-
কোন কাজ বা সেবা পেতে অতিরিক্ত “রেজিস্ট্রেশন ফি” বা “অ্যাডভান্স পেমেন্ট” চাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি ফাঁদ হতে পারে।
বিলিং এড্রেস এবং ব্যাংক ডিটেইলস নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য সাইটেই শেয়ার করুন।
অফলাইন ও অনলাইনে সতর্ক থাকুন:-
যদি আপনার কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে, তবে সরাসরি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচাই করুন। অনেক সময়, ক্ষতিকর স্ক্যাম থেকে রক্ষা পেতে আপনি সরাসরি সংস্থার কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারেন।
শেষকথা
অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তবে সচেতনতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করলে আমরা সহজেই এসব স্ক্যাম থেকে রক্ষা পেতে পারি। প্রযুক্তির উন্নতি যতই হোক, মানুষের সচেতনতা এবং নিরাপত্তার উপায়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য এবং অর্থ সুরক্ষিত রাখতে, ডিজিটাল দুনিয়ায় সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।